
সশস্ত্রবাহিনীকে অন্ধকারে রেখে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্যোগ অবিবেচনাপ্রসূত। রাষ্ট্রের সংস্কারের বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে অন্ধকারে রাখা হবে—এটাও কাম্য নয়।এ ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান যে কনসার্ন ব্যক্ত করেছেন তা যথার্থ। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করা দরকার।যার যে দায়িত্ব তাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। কাউকে অবজ্ঞা করা উচিত না। দেশের অগ্রগতি চাইলে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সবাইকে নিয়েই কাজ করতে হবে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সেনাপ্রধান তাঁর বাহিনীর সদস্যদের যা জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে যা বলেছেন, তাও সঠিক। তাঁর বক্তব্য ইতিবাচকভাবে নিয়ে সংকট নিরসনে সবাইকে দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে। নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে হবে। নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই দেশ পরিচালনা হওয়া দরকার। নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণে সংকট বাড়বে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সঠিক কথা বলেছেন। এসব মন্তব্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সামরিক বিশেষজ্ঞসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের। তাঁরা জানান, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশি ও বিদেশি অনেকে চায় সার্বিক সংকট থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ যেন না হয়। এ ধরনের একটি অপচেষ্টা চলমান। সেই অপচেষ্টা যেন কোনোভাবেই সফল না হতে পারে সেভাবেই সবার কাজ করা দরকার।
গত বুধবার ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তাঁঁর বাহিনীর সদস্যদের কাছে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনো যুক্ত হবে না। কাউকে তা করতেও দেওয়া হবে না। তিনি সব পর্যায়ের সেনাসদস্যকে নিরপেক্ষ থাকার এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনী দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের নির্দেশ দেন।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ওই অনুষ্ঠানে নির্বাচন ছাড়াও মানবিক করিডর, বন্দর, সংস্কারসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। সেনাপ্রধান জাতীয় নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়া উচিত বলে জানান।
সেনাপ্রধান বলেন, সার্বিকভাবে দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং এই পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসনসহ সব সংস্থা প্রত্যাশা অনুসারে পুনর্গঠিত হতে পারছে না। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডরসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, এটি ক্রিস্টাল ক্লিয়ার না। বিষয়টি স্পর্শকাতর, ঝুঁকিপূর্ণ ও অসম্ভব।
তিনি বলেন, মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে। এখানে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে, যা করার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই করতে হবে। যা-ই করা হোক না কেন, পলিটিক্যাল কনসেনসাসের (রাজনৈতিক ঐকমত্য) মাধ্যমে সেটা হতে হবে।
সেনাপ্রধান বলেন, আগস্ট থেকে সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু মহল তাঁকে ও সেনাবাহিনীকে অন্যায্যভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে।
‘মব ভায়োলেন্স’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা আক্রমণের বিরুদ্ধেও কঠোর বার্তা দেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
সংস্কার প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, কী সংস্কার হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, এ বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কোনো পরামর্শ বা আলোচনা করা হয়নি। পাশাপাশি বলেন, ‘অন্তর্র্বতী সরকারকে আমরা সহযোগিতা করছি। সহযোগিতা করে যাব। ’
এর আগেও সেনাপ্রধান ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর সেনাপ্রধান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, দেশ গঠনে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়ে আসছেন। সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, আমি সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে হস্তক্ষেপ করতে দেব না—এটা আমার স্পষ্ট অঙ্গীকার। অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সময়ে দেশ সেবায় সেনাবাহিনীর ভূমিকার ব্যাপক প্রশংসা করেন। গত ৬ অক্টোবর সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে ‘সেনা সদর নির্বাচনী পর্ষদ ২০২৪’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘দেশের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং একটি অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে দেশকে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ’ কিন্তু তার পরও বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাখতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অন্ত নেই। চলছে বিভেদ বাড়ানোর অপচেষ্টা।
বুধবারের অফিসার্স অ্যড্রেসে সেনাপ্রধানের বক্তব্য সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় বেশি। বিশিষ্টজনদের অনেকেরই ধারণা, সেনাপ্রধান সঠিক কথাই বলেছেন। সামিরক বিশেষজ্ঞ মে. জে. (অব.) ড. মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী সংস্কার এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তাগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে অন্ধকারে রাখা সম্পর্কে গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘সকল পর্যায়ে সবাইকে একটি লক্ষ্যে কাজ করা দরকার। সেটি হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা। নিজ নিজ অবস্থানে থেকে যার যে দায়িত্ব সে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যার যে দায়িত্ব তাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। কাউকে অবজ্ঞা করা উচিত না। দেশের অগ্রগতি চাইলে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সবাইকে নিয়েই কাজ করা উচিত। আপনি প্রত্যেকটা কম্পোনেন্টকে কিভাবে হ্যান্ডেল করছেন, তার ওপর সফলতা নির্ভর করে। আমরা ন্যাশনাল পাওয়ার বলি। এর বিভিন্ন এলিমেন্ট থাকে। ন্যাশনাল পাওয়ারের সব এলিমেন্ট যখন পুরো কাজে লাগাতে পারবেন তখনই আপনি সফল। কাউকে বাদ দিয়ে, দমন করে, একজনের দায়িত্বে অন্যজনকে বসিয়ে যখন কিছু অর্জন করতে চাওয়া হয়, তখন ন্যাশনাল পাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি আরো বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশি ও বিদেশি অনেকে চায় সার্বিক সংকট থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ যেন না হয়। এ ধরনের একটি অপচেষ্টা চলছে। সেই অপচেষ্টা যেন কোনোভাবেই সফল হতে না পারে সেভাবেই সবার কাজ করা দরকার। সবার বলতে সরকার ও সরকারের সব এলিমেন্টই শুধু নয়, জনসাধারণের কথাও বলছি। জনগণের মধ্য থেকে কারো বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করতে হলে, লিখতে হলে এই চিন্তা-ভাবনা করা উচিত, এটি আমাদের দেশের পক্ষে যাচ্ছে কি না। এ বিষয়েও জনসচেতনতা তৈরি করা দরকার। জনগণ সচেতন হলে বিভাজনের ইঙ্গিত যেগুলো দেখতে পাচ্ছি তা থেকে সরে এসে দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে পারব।
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খানের মূল্যায়ন, ‘অন্তর্র্বতী সরকার যেসব সংস্কার এবং যেসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কাজ করছে বলে আলোচনা হচ্ছে, সেসব নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মতামত তেমনভাবে নেওয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো এখানে অনেকটাই উপেক্ষিত। এ ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীসহ রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মতামত গ্রহণ বাঞ্ছনীয় ছিল। সংস্কার কমিটিগুলোতে তাদের প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন ছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মরতরা সবাই গণকর্মচারী। কিন্তু তাদের চাকরবাকর হিসেবে দেখা হবে, অবজ্ঞা করা হবে এটা হতে পারে না। তাঁরা শুধু অন্ধের মতো সরকারের নির্দেশ পালন করবেন তা নয়, দেশ গঠনে তাঁদেরও মতামত রাখার সুযোগ দিতে হবে। সেনাপ্রধান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত এবং নির্বাচন শেষে সেনাবাহিনীকে দ্রুত সেনানিবাসে ফিরতে হবে বলেছেন। আগেও তিনি এ কথা বলেছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। সেনাবাহিনীসহ সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য বেশি দিন বাইরে রাখলে তাতে বাহিনীর ক্ষতি হয়। ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া দরকার—এটা আমিও সমর্থন করি। এ বিষয়ে সবাইকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। তবে এ বিষয়ে সরকারের যে প্রচেষ্টা তাতে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। যদি বিশেষ একটি দলকে সংগঠিত করার এবং সে দলকে নানা সুযোগ ও সময় দেওয়ার পরিকল্পনা থাকে তাহলে ঐকমত্যে পৌঁছানোতে সমস্যা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ বলেন, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যে দেশের যে পারিস্থিতির কথা প্রকাশ পেয়েছে তার সঙ্গে আমি একমত। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সেনাপ্রধানের দূরদর্শী ইতিবাচক ভূমিকার কথা অবিস্মরণীয়। তাঁঁর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং এখনো দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ নানা বিপর্যয় মোকাবেলায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। নৌ এবং বিমান বাহিনীও একই ভূমিকার কারণে প্রশংসা পাচ্ছে। কিন্তু এই সশস্ত্র বাহিনীকে অন্ধকারে রেখে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্যোগ অবিবেচনাপ্রসূত। অন্তর্র্বতী সরকার এ ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়নি। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, সেই সশস্ত্র বাহিনীর মতামত না নিয়ে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য মানবিক করিডর বা ত্রাণ সহায়তা দিতে যাওয়ার উদ্যোগ যুক্তিযুক্ত না। এ ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান যে কনসার্ন ব্যক্ত করেছেন, তা যথার্থ। রাষ্ট্রের সংস্কারে সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করা যেত। কারণ সশস্ত্র বাহিনীরও সংস্কার প্রয়োজন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সেনাপ্রধান তাঁর বাহিনীর সদস্যদের যা জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে যা বলেছেন, তাও সঠিক। তাঁর বক্তব্য ইতিবাচকভাবে নিয়ে সংকট নিরসনে সবাইকে দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে। নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে হবে। নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই দেশ পরিচালনা হওয়া দরকার। নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণে সংকট বাড়বে। সূত্র: কালের কণ্ঠ