ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪,
সময়: ১০:১৪:১৭ PM

স্পেনে মুসলিমদের ৮০০ বছরের শাসন

লেখিকাঃ জান্নাত খাতুন, আন্তর্জাতিক বার্তা সম্পাদক, হাভার টার্ক।
19-09-2024 10:14:17 PM
স্পেনে মুসলিমদের ৮০০ বছরের শাসন

পর্ব-০১ ।।  ভূমধ্যাসাগরে জিব্রাল্টার প্রণালীর তীরে একটি সবুজ পাহাড় রয়েছে। যেটি ব্রিটেনের ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি। ব্রিটেনের নিরাপত্তার জন্য এই ঘাঁটিকে দ্যা রক (ঞযব জড়পশ) বা পাথরও বলা হয়। এই পাহাড়টি এবং এর আশেপাশের জমিগুলো একটি ছোট সংযোগ স্থলের মাধ্যমে স্পেনের সাথে সংযুক্ত। এখানে ব্রিটেন সেনারা থাকে। এখানে ৩৩ হাজার স্থানীয় অধিবাসীও রয়েছে। যারা ব্রিটেনের নাগরিক। এখানে মুসলিম শাসনামলের একটি দুর্গের ধংসাবশেষ আছে। এছাড়া এখানে একটি মসজিদও আছে। যা সৌদি আরবের প্রাক্তন বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই পাহাড় এবং এর আশেপাশের জমি স্পেন ১৭১৩ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেনের কাছে হস্তান্তর করে। এই ঘাঁটির মাধ্যমে ব্রিটেন জিব্রাল্টার প্রণালী তথা ভূমধ্যসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরের সংযোগ স্থলকে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রিটেন চাইলে এই প্রণালী বন্ধও করতে পারে। ব্রিটেন প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির পথ আটকানোর জন্য জিব্রাল্টার প্রণালী বন্ধও করেছিলো। এই জায়গার কৌশলগত গুরুত্ব ছাড়াও একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। আজ থেকে ১৩০০ বছর পূর্বে ৭১১ সালের মে মাসে কিংবদন্তী মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ ৭ থেকে ১০ হাজার সৈন্যের সেনাবাহিনীর সাথে এই পাহাড়ের কাছাকাছি অবতরণ করেন। সেই থেকে এই পাহাড়ের নাম জাবাল-আত-তারিক বা তারিকের পাহাড়। যা ইউরোপীয় ভাষায় বিকৃত হতে হতে জিব্রাল্টার হয়ে যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই পাহাড় এবং এর আশেপাশের এলাকাকে জিব্রাল্টার বলা হয়। আর এই পাহাড় সংলগ্ন প্রণালীকে জিব্রাল্টার প্রণালী বলা হয়। আজ থেকে ১৩০০ বছর পূর্বে যখন তারিক বিন যিয়াদ (ঞধৎরয় রনহ তরুধফ) তাঁর সেনাবাহিনীসহ জিব্রাল্টারে অবতরণ করেছিলেন তখন সমুদ্রের ওপারের সমগ্র উত্তর আফ্রিকা তৎকালীন সুপার পাওয়ার উমাইয়া খিলাফাতের অংশ ছিলো। উমাইয়া খিলাফাতের রাজধানী ছিলো আজকের সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। 

তখন আফ্রিকাকে আফ্রিকিয়া বলা হতো। উমাইয়ারা এক আরব সেনাপতি মুসা বিন নুসাইরকে আফ্রিকিয়ার গভর্নরের দ্বায়িত্ব দিয়েছিলো। ইসলামি ইতিহাসের বিখ্যাত বই ফাতহু বুলদান মোতাবেক মুসা বিন নুসাইর একজন গোলাম ছিলেন। যাকে উমাইয়ারা মুক্ত করে আফ্রিকিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করে। মুসা বিন নুসাইরের রাজধানী ছিলো আজকের তিউনিসিয়ার শহর কিরওয়ান। মুসা বিন নুসাইর আজকের মরোক্কোর একটির শহর তানজা জয় করে বার্বার গোত্রের এক গোলাম তারিক বিন যিয়াদকে তানজা শহরের শাসক বানান। উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন গোত্রের লোকেদের বার্বার বলা হতো। তারিক বিন যিয়াদ একজন নওমুসলিম ছিলেন। অর্থ্যাৎ তিনি সবে মাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আল জেরিয়ার লোক ছিলেন। তারিক বিন যিয়াদ মুসা বিন নুসাইরের বিশস্ত এবং দক্ষ সেনাপতি ছিলেন। মুসা বিন নুসাইর যখন স্পেন জয় করা সিদ্বান্ত নিয়েছিলেন তখন মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি তারিক বিন যিয়াদকে স্পেনে গিয়ে সেখানকার অবস্থা, মানুষের জীবন যাপনের ধরণ, গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে তথ্যসংগ্রহ ও বন্ধু বানানোর নির্দেশ দেন। অর্থ্যাৎ এখনই যুদ্ধ নয়। যুদ্ধ পরে করা হবে। তারিক বিন যিয়াদ ৭ হাজার সৈনিক জড়ো করলেন। তাদের জাহাজে উঠালেন এবং জিব্রাল্টারের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন। তারিক বিন যিয়াদের সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সৈনিক বার্বার ছিলেন। এছাড়া সেনাবাহিনীতে কিছু সংখ্যক সিরিয় এবং ইয়েমেনি সৈন্যও ছিলো। জিব্রাল্টার ছিলো স্পেনে প্রবেশের সবচেয়ে সহজ পথ। হয়তো এজন্যই তারিক বিন যিয়াদ জিব্রাল্টারকে বেছে নিয়েছিলেন। স্পেনের সেনাবাহিনী ধারণাও করতে পারে নি যে, এই ছোট্ট পাগাড়ি উপত্যকা দিয়ে এতবড় সেনাবাহিনী স্পেনে প্রবেশ করে। স্পেনের সেনাবাহিনী ও শাসকরা এই পাহাড়কে অগুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলো। এজন্য সেখানে নজরদারির জন্য কোন সেনাদল কিংবা দুর্গ রাখে নি। কিংবা দুর্গ থাকলেও তা খালি ছিলো। 

তারিক বিন যিয়াদ ও তাঁর সেনাবাহিনী বিনা বাধায় স্পেনে প্রবেশ করলো। তারিক বিন যিয়াদের সেনাবাহিনী হামলা করার জন্য নয় বরং গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্যই স্পেনে গিয়েছিলো। জিব্রাল্টারে অবরতরণের পর তারিক বিন যিয়াদ তাঁর সৈনিকদের জাহাজ পুড়িয়ে ফেলতে আদেশ দেন। কারণ তারিক বিন যিয়াদ আর সাথীর দেখেছিলো যে, মাইলের পর মাইল জমি খালি পড়ে রয়েছে। আর স্পেনের শাসকগণ এই হামলার আশংকাও করছে না। তাই তারিক বিন যিয়াদ ভাবলো যে, যদি অবস্থা এরকম হয় তাহলে এই ছোট্ট সেনাবাহিনীর জন্যও স্পেন জয় করা খুব একটা কঠিন হবে না। তারিক বিন যিয়াদের সৈনিকরা জাহাজ পোড়ানোর আদেশে হতবাক হয়ে যায়। তাও তারিক বিন যিয়াদ তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তারিক বিন যিয়াদের আদেশে সকল জাহাজ প্ুিড়য়ে দেওয়া হয়। এরপর তারিক বিন যিয়াদ তাঁর সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে মনোবল চাঙ্গাকারী এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তারিক বিন যিয়াদ বলেন, - " আমার ভাইয়েরা। আমরা এখানে আল্লাহর দ্বীনের প্রসারের জন্য এসেছি। শত্রু আপনাদের সামনে আর সমুদ্র আপনাদের পিছনে। এখন আপনাদের আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যুদ্ধ করতে হবে। হয় আপনারা জয়ী হবেন কিংবা শহীদ। এছাড়া আর অন্য কোন বিকল্প নেই।" তারিক বিন যিয়াদ ও তাঁর সেনাবাহিনীর জীবনের নিশ্চয়তা শুধুমাত্র বিজয় অর্জনের ওপরই ছিলো। কারণ এখন ফিরে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। তারিক বিন যিয়াদ হয় মৃত্যু না হয় বিজয়ের যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লেন এবং সেই গতিতে এগিয়ে যেতে লাগলেন। এখানে দুটি প্রশ্ন উঠে। এক, মুসলিমরা স্পেনে কেন হামলা করেছিলো কিংবা মুসা বিন নুসাইর কেন স্পেনে হামলা করার সিদ্ধান্ত নেন? দুই, তারিক বিন যিয়াদের লড়াই কার সাথে ছিলো? চলুন স্পেনে মুসলিমদের ৮০০ বছরের শাসন ও নানা ভুলের কথা সিরিজের ১ম পর্বে এ সম্পর্কে জানা যাক। 

যখন তারিক বিন যিয়াদ স্পেনে হামলা করছিলেন তখন সেই জায়গাকে স্পেন বলা হতো না। তাকে আইবেরিয়ান পেনিনসুলা (ওঊইঊজওঅঘ চঊঘওঘঝটখঅ) বলা হতো। এই জায়গায় কয়েক শো বছর পূর্বে রোমানদের শাসন ছিলো। রোমানরা এই অঞ্চলকে হিসপানিয়া বলতো। আর মুসলিমরা এই অঞ্চলকে আল আন্দালুস বলতো। আইবেরিয়ান পেনিনসুলার প্রাচীন বসবাসকারীদেরকে ভ্যান্ডেল বা অ্যান্ডেলস বলা হতো। বলা হয়ে থাকে এই ভ্যান্ডেলস বা অ্যান্ডেলস শব্দটি আরবীতে গিয়ে আন্দালুস হয়ে যায়। এজন্য মুসলিমরা এই অঞ্চলকে আল আন্দালুস বলতো। তারিক বিন যিয়াদ যখন স্পেনে হামলা করেন তখন একটিমাত্র জাতির বসবাস ছিলো না। বরং বিভিন্ন অংশ থেকে আগত বিভিন্ন যাযাবর জাতি এখন বসবাস করতো। ইউরোপের একটি যাযাবর গোষ্ঠীর নাম ছিলো ভিসিগোথ। এরা ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলো। ৪১৮ সালে এরা স্পেনের প্রাচীন বাসিন্দা ভ্যান্ডেলস কিংবা অ্যান্ডেলসদের পরাজিত করে এই অঞ্চলে ভিসিগোথিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ভিসিগোথিক সাম্রাজ্য তাঁর স্বর্ণযুগে স্পেন, পর্তুগাল, মরোক্কোর পাশের কিছু এলাকা এবং ফ্রান্সের কিছু এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। মুসলিমদের আগমণের প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিলো। বলা হয়ে থাকে প্রত্যেক স্বর্ণযুগ বা শক্তির সর্বোচ্চ সীমার পরই প্রত্যেক সাম্রাজ্যের পতন হয়। ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। ভিসিগোথিক সাম্রাজ্য বহ্যিক দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী মনে হলেও মুসলিমদের আগমণের পূর্বে এই সাম্রাজ্যের ক্ষমতা এমন এক ব্যক্তি লাভ করে যে, সাম্রাজ্যকে দূর্বল করে দেয়। ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের ঐক্যকে ছিন্ন বিছিন্ন করে দেয়। ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যে পারস্পরিক মত পার্থক্য এমন এক পর্যায়ে পৌছায় যে, সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই শাসকের নাম ছিলো রডরিক (জড়ফবৎরপ)। ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের সম্রাট বা রাজা রডরিক ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের রাজ পরিবারের সদস্য ছিলো না। রডরিকের পূর্বের জীবন সম্পর্কে ইতিহাসে কোন বক্তব্য পাওয়া যায় না। 

ধারণা করা হয় রডরিক ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের কোন প্রদেশের গভর্নর ছিলেন। ৭১০ সালে যখন ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের সম্রাটের মৃত্যু হয় তখন রডরিক ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের কিছু মন্ত্রীর সহায়তায় রডরিক ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। সম্রাটের ছেলেদের বঞ্চিত করে। এর ফলে রডরিকের শাসনকালের শুরু থেকেই তাঁর শাসন বিতর্কিত ছিলো। সাম্রাজ্যের অধিকাংশ অংশে রডরিককে আইনগত সম্রাট মানা হয় নি। ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের মন্ত্রীগণ রডরিকের বিরোধী হয়ে উঠে। ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর যারা রডরিককে পছন্দ করতো না তারা এবং প্রাক্তন সম্রাটের ছেলেরা রডরিকের শাসন শেষ করার জন্য পরিকল্পনা করতে লাগলো। রডরিকের এরকম এক বিরোধীর নাম ছিলো কাউন্ট জুলিয়ান (ঔঁষরধহ, ঈড়ঁহঃ ড়ভ ঈবঁঃধ)। কাউন্ট জুলিয়ান সমুদ্রের ওপারে আফ্রিকা মহাদেশে থাকা ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের প্রদেশ ঈবঁঃধ সাবতা বা সিউটার গভর্নর। যা আজ মরোক্কোর সীমান্তবর্তী। এই অঞ্চলটি আজও স্পেনের সায়ত্তশাসিত এক কলোনি। তারিক বিন যিয়াদের সময়েও এই এলাকা ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের অংশ ছিলো। এই এলাকার গভর্নর কাউন্ট জুলিয়ান রডরিককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য মুসলিমদের সমর্থন করছিলেন এবং মুসলিমদের সাহায্য চাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি কেন রডরিকের বিরোধীতা করছিলেন? এর উত্তরে একটি কিংবদন্তী বর্ণনা করা হয় যা সত্যও হতে পারে। আবার মিথ্যাও হতে পারে। বলা হয়  কাউন্ট জুলিয়ানের মেয়ে লাকাভা অত্যন্ত সুন্দরী ছিলো। কাউন্ট জুলিয়ান তাঁর মেয়ে লাকাভার শিক্ষার জন্য তাঁকে ভিসিগোথিক সাম্রাজ্যের সম্রাটের প্রাসাদে পাঠায়। রডরিকের রাজধানী ছিলো টলিডো। যাকে আরবীতে তালিতলাও বলা হয়। লাতাভা যখন টলিডোর রাজ প্রাসাদে পৌঁছানোর পর রাজা রডরিক লাকাভার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান।