সারাদেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬৮ হাজারের বেশি শিক্ষকের পদ শূন্য। সম্প্রতি নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন সাড়ে ৩২ হাজারের মতো প্রার্থী। এখনো শূন্য প্রায় ৩৬ হাজার পদ। এর মধ্যে ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিত, আইসিটি, নারী কোটাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আবেদনের সংখ্যা কম হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে দাবি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ)।শিক্ষক নিয়োগের ফল প্রকাশের পর থেকে অভিযোগের স্তূপ জমেছে এনটিআরসিএতে। একদিকে শূন্যপদে আবেদন আসছে না, অন্যদিকে সব যোগ্যতা থাকার পরও নিয়োগ না পেয়ে এনটিআরসিএ’র গেটে এসে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন প্রার্থীরা। এর প্রতিকারে রোববার (১৯ মার্চ) নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এনটিআরসিএতে ভুক্তভোগীরা স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন।এনটিআরসিএ সূত্রে জানা যায়, সারাদেশের স্কুল-কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬৮ হাজার ১৬৭ শিক্ষকের শূন্য পদে নিয়োগে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে এনটিআরসিএ। এর পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষাধিক আবেদন জমা পড়ে। গত ২৯ জানুয়ারি অনলাইনে আবেদন শেষ হয়। ১২ মার্চ চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফল প্রকাশ করা হয়। এতে প্রাথমিকভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন ৩২ হাজার ৪৩৮ জন এনটিআরসিএ নিবন্ধিত প্রার্থী। বাকি ৩৫ হাজার ৭২৯টি পদে বিষয়ভিত্তিক আবেদন না পড়ায় সেসব পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে এনটিআরসিএ’র জাতীয় মেধা তালিকায় এগিয়ে থেকে আবেদন করেও নিয়োগবঞ্চিত হয়েছেন অর্ধলাখ প্রার্থী। প্রতিদিন তারা ঢাকার ইস্কাটনের এনটিআরসিএ অফিসে অভিযোগ নিয়ে ভিড় জমান। তাদের অভিযোগ আমলে নেওয়া হচ্ছে না বলে জানান ভুক্তভোগীরা।মেধা তালিকায় ১ হাজার ৩৩৮ অবস্থানে থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান (স্কুল) বিষয়ে নিয়োগের জন্য আবেদন করেও নিয়োগ পাননি মৌসুমি খাতুন। এনটিআরসিএতে লিখিত অভিযোগ এনে প্রবেশ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে। কথা বলে জানা যায়, এই প্রার্থী যেসব বিদ্যালয়ে আবেদন করেছেন সেখানে তার চেয়ে মেধা তালিকায় পিছিয়ে থাকাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিকার পেতে তিনি অভিযোগ দাখিল করতে এসেছেন।
তার মতো এমন অনেক প্রার্থীর নানা ধরনের অভিযোগের স্তূপ তৈরি হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানে। নিয়োগের সুপারিশে অসঙ্গতি ও ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনে রোববার শতাধিক প্রার্থী মিলিত হয়ে এনটিআরসিএতে স্মারকলিপিও জমা দিয়েছেন।
এনটিআরসিএ’র সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানা যায়, সারাদেশে ৬৮ হাজার ১৬৭ জনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও একাধিক বিষয়ভিত্তিক পদে আবেদন অনেক কম আসায় সেগুলো শূন্য রয়ে গেছে। তার মধ্যে ইংরেজি বিষয়ে প্রায় সাড়ে আট হাজার পদ শূন্য থাকলেও চার হাজারের মতো আবেদন আসায় আরও প্রায় চার হাজার পদ শূন্য। বিজ্ঞান বিষয়ে প্রায় ১০ হাজার শূন্য পদের বিপরীতে সাত হাজার আবেদন পড়লেও তিন হাজার খালি, আইসিটি বিষয়ে চার হাজারের বেশি পদে ৯শ আবেদন পড়ায় তিন হাজারের বেশি পদ শূন্য, মাদরাসায় মৌলভি পদে সাড়ে তিন হাজার পদ শূন্য। নারী কোটায় ১৪ হাজারের বেশি পদ শূন্য। এসব বিষয়ে যারা আবেদন করেছে তাদের সবাইকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে এনটিআরসিএ।জানতে চাইলে এনটিআরসিএ’র নিয়োগ শাখার উপ-পরিচালক কাজী কামরুল আহসান বলেন, ইংরেজি, আইসিটি, বিজ্ঞান, মৌলভি, নারী কোটাসহ বিভিন্ন বিষয়ে শূন্যপদের অর্ধেকও আবেদন আসেনি বলে সেসব পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে চাকরির ইনডেক্সধারী শিক্ষক ও ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বের প্রার্থীদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে আবেদন কম হয়েছে।তিনি বলেন, যে সাড়ে ৩২ হাজার প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যেও অনেকে বাদ যাবেন। এদের মধ্যে কারও একাধিক নিবন্ধনের সনদ থাকায় তারা স্কুল ও কলেজে আলাদাভাবে আবেদন করেছেন। এসব প্রার্থীর একটি আবেদন বাতিল করে কলেজ পর্যায়ে নিয়োগ দেওয়া হবে। কোনো কোনো ইনডেক্সধারী তথ্য গোপন করে কৌশল অবলম্বন করে আবেদন করেছেন। অনেক নারী প্রার্থীর নিজ অবস্থান থেকে দূরত্ব বেশি থাকায় যোগদান করবেন না। এমন নানা কারণে সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের একটি বড় অংশ বাদ যাবে। সে কারণে শূন্য পদের সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে।
এদিকে স্মারকলিপি দেওয়া একাধিক প্রার্থী বলেন, মেধা তালিকায় এগিয়ে থাকলেও আমাদের নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমাদের চেয়ে সিরিয়ালে পিছিয়ে থাকা অনেক প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ দেখে মানসিকভাবে আমরা ভেঙে পড়েছি। সারা জীবনের আদর্শ শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন মুহূর্তেই ভেঙে গেছে।
ভুক্তভোগীরা বলেন, মেধাতালিকায় এগিয়ে থাকলেও তাদের আইডি ব্লক করে রাখা হয়েছিল। মেধা তালিকা সার্চ করতে গিয়ে বিষয়টি শনাক্ত হয়। সেখানে ব্যাচ ও নাম আলাদা হলেও জাতীয় মেরিট লিস্টে আমাদের রোলের মতো একাধিক রোল দেখা গেছে। এনটিআরসিএতে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ায় প্রতিটি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। দ্রুত এসব সমস্যা সমাধান করে নিয়োগের দাবিতে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। দাবি মেনে নেওয়া না হলে সবাই মিলে আন্দোলনে নামবো।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান মো. এনামুল কাদের খান বলেন, আমাদের কাছে থাকা বিভিন্ন পদে শূন্যপদের চেয়ে আবেদন তুলনামূলক কম আসায় সেসব পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমানে এসব শূন্যপদে বিশেষভাবে নিয়োগ দেওয়া যায় কি না সেজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানতে চাওয়া হবে। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দিলে সব শূন্যপদের জন্য বিশেষ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রার্থীদের কাছে আবেদন চাওয়া হবে।
অনেকে মেধা তালিকায় এগিয়ে থাকলেও তারা নিয়োগ পাননি বলে অভিযোগ করছেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভুল-ত্রুটি কিছু হতে পারে। এটি আমাদের হাতে নয়, সব কাজ সফটওয়্যারের মাধ্যমে করা হয়। টেলিটকের মাধ্যমে ফলাফল তৈরি করা হয়। যারা অভিযোগ দিচ্ছে আমরা তাদের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করছি। টেকনিক্যাল কারণে কারও ভুল শনাক্ত হলে তা সংশোধন করা হবে।
তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় মেধা তালিকার বাইরে বিষয়ভিত্তিক মেধা তালিকা রয়েছে। কেউ বিষয়ভিত্তিক তালিকায় এগিয়ে থাকলে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সে কারণে জাতীয় মেধাতালিকায় এগিয়ে থাকলেও তারা পিছিয়ে পড়েন। এ ধরনের অভিযোগ বেশি আসছে।