ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫,
সময়: ০৪:৩০:১৮ PM

প্রতিশোধ: সমাজের অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
11-11-2025 02:34:15 PM
প্রতিশোধ: সমাজের অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি

২০২৫ সালের ৯ জুলাই, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে পড়ে থাকা এক দেহকে ঘিরে উত্তেজিত জনতা। কয়েকজন বড় বড় পাথর ছুড়ে মারছে সেই দেহে। এভাবেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ৩৯ বছর বয়সী ভাঙারি ব্যবসায়ী মো. সোহাগ ওরফে লাল চাঁদকে। হত্যার পরও ক্ষান্ত হয়নি হামলাকারীরা—বুকের ওপর দাঁড়িয়ে করে বুনো উল্লাস। এই নৃশংস দৃশ্য পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। এর মাত্র এক মাস পর, ৭ আগস্ট গাজীপুরে সহিংসতার দৃশ্য ধারণ করায় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ সোমবার (১০ নভেম্বর) প্রায় ২৯ বছর আগের একটি হত্যা মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে খুন হন তারিক সাইফ মামুন (৫৫)। ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে দুই দুর্বৃত্ত কাছ থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে তাকে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। গুলি ছুড়েই হামলাকারীরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সরে যায়।

এভাবে একের পর এক সহিংস হত্যাকাণ্ড, গণপিটুনি, রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও পারিবারিক সংঘাতে প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ। রাজনীতি থেকে পারিবারিক সম্পর্ক—সবখানেই ছড়িয়ে পড়ছে হিংস্রতা ও প্রতিশোধের সংস্কৃতি। মানবিক মূল্যবোধ যেন হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানিয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৮১ জন নিহত ও ছয় হাজার ৬৯৮ জন আহত হয়েছেন। গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৫৩ জন, বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ৪০ জন এবং কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৮৮ জনের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সহিংসতা বাড়ার মূল কারণ দুর্বল আইনের শাসন ও বিচারহীনতা। অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যাচ্ছে, বিচার দীর্ঘসূত্রতায় বিলম্বিত হচ্ছে। পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, সহমর্মিতা ও আস্থার অভাব, এবং সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণ পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সহিংসতা প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, দ্রুত ও কার্যকর বিচার নিশ্চিত করা, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা ও সহমর্মিতা চর্চা জোরদার করা, গণমাধ্যম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সম্পৃক্ত করা এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সহিংসতা উসকানিমূলক বক্তব্য নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহানা পারভীন বলেন, “মানুষের এই নিষ্ঠুর হয়ে ওঠার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। প্রাচীনকালেও টিকে থাকার লড়াইয়ে মানুষ হিংস্র ছিল, কিন্তু এখন প্রতিশোধ ও ক্ষমতার প্রকাশ সামাজিক সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে। খুবই তুচ্ছ কারণেও মানুষ হত্যা করছে—কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে।”

তিনি আরও বলেন, “ব্যক্তিত্বের ধরন বড় ভূমিকা রাখে। কেউ কেউ অত্যন্ত আবেগপ্রবণ, সহনশীলতা কম, হিংসাত্মক প্রবণতা বেশি। শৈশবে নির্যাতন বা সহিংসতার অভিজ্ঞতা থাকলে সেই ট্রমা পরবর্তী জীবনে প্রতিশোধমূলক আচরণ বাড়ায়। শিশুকালে সহিংসতার দৃশ্য দেখলে তার মনে নিষ্ঠুরতা সহজেই গেঁথে যায়।”

ডা. শাহানা বলেন, “এখন সমাজে সহিংসতাকে গ্লোরিফাই করা হচ্ছে—সিনেমা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা রাজনীতিতেও দেখা যায়, খুনি বা অপরাধীকে অনেক সময় নায়ক বানানো হয়, ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। এতে অন্যদের মধ্যেও সেই ক্ষমতার নেশা কাজ করে। অনেকেই হীনমন্যতা বা আত্মবিশ্বাসহীনতা কাটাতে অন্যকে দমন করে মানসিক তৃপ্তি পেতে চায়। খুনের পর লাশ বিকৃত করা সেই আত্মতৃপ্তি বা ক্ষমতার অনুভূতির প্রকাশ।”

তিনি মনে করেন, সহিংসতা রোধে কেবল আইন প্রয়োগ যথেষ্ট নয়—মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, নৈতিক শিক্ষা ও পারিবারিক সহমর্মিতা ফিরিয়ে আনতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “নৃশংস হত্যাকাণ্ড, গণপিটুনি বা অন্যান্য সহিংসতা শুধু ব্যক্তিগত রাগ বা প্রতিশোধ নয়—এগুলো সমাজব্যবস্থার গভীর অসুস্থতার প্রতিফলন। দুর্বল আইনের শাসন, বিচার বিলম্ব এবং সামাজিক সংহতির ভঙ্গুরতা অপরাধীদের উৎসাহিত করছে।”

তিনি আরও বলেন, “যখন অপরাধীরা পার পেয়ে যায় বা বিচার দীর্ঘ হয়, তখন সহিংসতা অপরাধীর কাছে ক্ষমতা প্রদর্শনের উপায় হয়ে ওঠে। পরিবার ও সমাজে আস্থা ও সংহতির অভাবও অপরাধপ্রবণতা বাড়াচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী, অভিভাবক-সন্তান বা প্রতিবেশীর সম্পর্কেও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে।”

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সংগঠন মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি লিড মনিরা রহমান বলেন, “নিষ্ঠুরতা একদিনে জন্মায় না। যখন সমাজে অপরাধের বিচার হয় না এবং সামাজিক প্রতিরোধ তৈরি হয় না, তখন মানুষ ধীরে ধীরে সহিংসতাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়। নৃশংস ঘটনাগুলো নিয়ে ক্ষণিক আবেগ দেখালেও আমরা বড় পরিসরে নীরব থাকি।”

তিনি বলেন, “সহমর্মিতা, সহনশীলতা ও মানবিক যত্নের চর্চা না থাকলে হিংসা ও বিদ্বেষ সমাজে বেড়ে যায়, এবং সহিংস আচরণ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের সহিংসতার ধারাবাহিকতা দেখাচ্ছে, সমাজে নৈতিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একাত্ম হতে পারছি না, বরং নীরবে মেনে নিচ্ছি। এই নীরবতা অপরাধীদের সাহস বাড়াচ্ছে।”

মনিরা রহমানের মতে, “এই প্রবণতা কেবল আইন প্রয়োগে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। পরিবার, স্কুল, কমিউনিটি এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সহমর্মিতার চর্চায় ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে এই নিষ্ঠুরতা সমাজের গভীরে আরও শেকড় গেড়ে বসবে।”

প্রতিদিন কেউ না কেউ সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। শান্তি ও মানবিকতার সমাজ গড়তে হলে আইনের শাসনের পাশাপাশি প্রয়োজন সহানুভূতি ও নৈতিকতার পুনর্জাগরণ। যতদিন মানুষ নিজের রাগ, ঘৃণা ও প্রতিশোধের আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারবে, ততদিন সহিংসতার এই চক্র থামবে না—বিশেষজ্ঞদের এমনই মত।