ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪,
সময়: ০৯:৩৪:১৮ AM

শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় শেষ জীবনে

সেবিকা রানী
27-12-2024 09:34:18 AM
শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় শেষ জীবনে

শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় শেষ জীবনে বালিয়াগড়এসে বাড়ী তৈরি করেছিলেন । যাদবপুর থেকে একজন ভদ্রমহিলা মাঝে মধ্যেই শরৎচন্দ্রের বাড়ীতে আসতেন ।ভদ্রমহিলা শরৎ বাবু কে দাদু বলে ডাকতেন ।শরৎ বাবুও ঐ ভদ্রমহিলা কে ছোট বোনের মতো স্নেহ করতেন । একদিন ঐ মহিলা শরৎ বাবু কে তার যাদবপুরের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করলেন । নিমন্ত্রণ পেয়ে শরৎ বাবু বললেন "আমি শিং মাছের ঝোল পছন্দ করি তুমি যদি তা খাওয়াতে পারো তবে নিশ্চয়ই যাব ।ভদ্র মহিলা রাজি হলেন এবং শরৎ চন্দ্র নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন ।

ভদ্র মহিলা বাড়ীতে এসে সকাল সকাল যথারীতি ঘটা করে রান্নাবান্নার কাজ সেরে নিলেন ।ঠিক সেই সময়ে ভদ্র মহিলার ননদ তার মায়ের কাছে গিয়ে বললেন, "মা!বৌদি কাকে নিমতন্ন করে বাড়ীতে আনছেন তা শুনেছো? মা তো অবাক! ননদ বললেন লেখক শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় গো! লোকটা যেমন মাতাল তেমনি চরিত্রহীন, লম্পট । মেয়ে ছেলে নিয়ে সব সময়

পড়ে থাকে । মেয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে মা তো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন ।অমনি বৌ মাকে ডেকে বলে দিলেন । বউ মা দ্যাখো, এটা গৃহস্থ বাড়ী । গৃহস্থ বাড়ীতে ওসব একদম চলবে না । ভদ্র মহিলা শ্বাশুরীর

এমন অগ্নি রূপ দেখে আকাশ থেকে পড়লেন । তিনি শ্বাশুরীকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করলেন তাতে কিছুতেই কিছু হলো না ।অগ্যতা তিনি ছুটে গেলেন শরৎ চন্দ্রের বাড়ীতে । সেখানে তিনি শরৎ বাবু কে সব খুলে বললেন । সেদিন শরৎ বাবু আর সেই বাড়ীতে নিমন্ত্রণ খেতে গেলেন না । শরৎ বাবু নিজেই অকপটে বলেছেন "সজ্জন সমাজে আমি অপাংতেয় । কথাটা কিন্তু একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয় । সে সময়ে ভদ্র সমাজে তিনি ছিলেন অবাঞ্ছিত ।

রেঙ্গুন শহরে শরৎ চন্দ্র কয়েকজন বন্ধু কে নিয়ে সেখানকার এক নাম করা পতিতা মেয়ে কে দেখতে গিয়েছিলেন । গিয়ে দেখলেন মেয়েটির কঠিন বসন্ত রোগ হয়েছে ।তা দেখে শরৎ চন্দ্রের বন্ধুরা সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে পালিয়ে চলে গেলেন । কিন্তু শরৎ বাবু মেয়েটি কে একা রেখে চলে যেতে পারলেন না । তিনি নিজের টাকা খরচ করে ডাক্তার ডাকলেন, যথারীতি ঔষধ পত্র আনলেন ।অনেক সেবা যতœ করলেন ।এতো চেষ্টা করেও মেয়েটি কে অবশেষে বাঁচানো গেল না ।

মেয়েটিকে সৎকার করেই শরৎবাবু বাড়ী ফিরলেন ।

এই ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । বন্ধু গিরীন্দ্র নাথ সরকার তার বঙ্গদেশে শরৎচন্দ্র বইটিতে লিখেছেন একদিয়ে উচ্ছৃঙ্খল এক যুবক, দিনরাত মদের নেশা ও আঁফিমে বুঁদ হয়ে থাকতেন ।আর অধিকাংশ সময় কাটাতেন শহরের নিষিদ্ধ পল্লীতে ।আপনারা সকলেই জানেন যিনি দিনরাত পতিতা পল্লীতে তাকে সমাজের লোকজন কখনো ভালো চোখে দেখেনা ।চরিত্রহীন, লম্পট ইত্যাদি লেভেল তার পিঠে লাগিয়ে দেয়া হতো ।

শরৎ বাবুর ক্ষেত্রেও তা বিন্দু মাত্র ব্যতিক্রম ঘটেনি ।রেঙ্গুন শহরে চরিত্রহীন বা লম্পট বিশেষণ তিনি তার ঘাড়ে নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায় । এই বিশেষণ গুলো হয়ে উঠেছিল অলংকার । বলা বাহুল্য এই বিশেষণ ধর্মী কলঙ্কের অলংকার গুলো তিনি কখনো কোন কালেই খুলে রাখার দায় অনুভব করেন নি ।

১৯১২ সালে একবার তিনি রেঙ্গুন থেকে একমাসের ছুটি নিয়ে এসেছিলেন হাওড়ার ঘোড়াডাঙ্গা এলাকার এক নিষিদ্ধ পল্লীতে । সেখানে হঠাৎ করেই উপস্থিত হয়েছিলেন তার আপন মামা উপেন্দ্র নাথ গঙ্গোপাধ্যায় উরফে উপেন বাবু ।সেদিন বহু কষ্টে উপেন বাবু বাড়ী খোঁজে বের করে সেই বাড়ির সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন উপেন বাবু । বাড়ীর সামনে একটি মেয়ে সুদৃশ্য চুলের বেণী করে অদ্ভুত ভঙিমায় দাঁড়িয়েছিল ।উপেন বাবু ইতস্তত বোধ করেই মেয়ে টিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন "আচ্ছা শরৎ চন্দ্র চট্রোপাধ্যায় নামে এখানে কেউ কি থাকেন ? প্রশ্ন শুনে মেয়েটি বিনম্র স্বরে জবাব দিলো

" ও দাদা ঠাকুর? তিনি উপরে থাকেন ।আপনি পাশের সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যান " ।উপেন বাবু উপরে গিয়ে দেখলেন শরৎচন্দ্র একাগ্র চিত্তে মগ্ন হয়ে চরিত্রহীন উপন্যাসটি লিখছেন । সেদিন বাড়ি ফিরে আসার সময় উপেন বাবু লক্ষ্য করেছিলেন সেই নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের কাছে শরৎচন্দ্র কারো কাছে বাবা ঠাকুর কারো কাছে দাদা ঠাকুর আবার কারো কাছে দেবতা ।

১৯২৩ সালে শরৎচন্দ্রের আঁধারে আলো গল্প নিয়ে তৈরি

হয়েছিল নির্বাক চলচ্চিত্র । শরৎচন্দ্রের গল্প নিয়ে সিনেমা সেই প্রথম । পরিচালক শিশির কুমার ভাদুরীর

অনুরোধে মনমোহন থিয়েটারে বেশ কয়েকবার শরৎচন্দ্র আঁধারের আলো সিনেমাটি দেখতে এসেছিলেন । সিনেমা শেষ হলে প্রতিবারই ননী স্যান্নাল

শরৎ চন্দ্র কে বাড়ির পথে এগিয়ে দিতেন ।তা ননী স্যান্নাল বলেছেন "সে সময়ে শরৎ বাবু সরাসরি হাওড়ার সেই বাড়িতে না গিয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে দুঃস্থ অসহায় মেয়েদের খোঁজ খবর নিতেন এবং তাদের হাতে কিছু টাকা কড়ি ধরিয়ে দিয়ে তবেই না বাড়ি

ফিরতেন । রেঙ্গুন বলুন আর হাওড়া বলুন তিনি যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই দিনের পর দিন এভাবেই দুঃস্থ অসহায় পতিতাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এভাবেই নিষিদ্ধ পল্লীতে সময় কাটিয়েছেন । কিন্তু তিনি কখনো পতিতাদের খদ্দের হয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে আনাগোনা করেন নাই । যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখনই তিনি অসহায় মেয়েদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন । কারো কলেরা থেকে বাঁচিয়েছেন তুলেছেন, কারো ঔষধ পথ্যের ব্যবস্থা করেছেন, কারো আহারের ব্যবস্থা করেছেন ,কারো ঘরের চালা ঠিক করে দিয়েছেন ।তাকে দেবতার আসনে বসিয়েছিল সেই সব নিষিদ্ধ পল্লীর নষ্টা মেয়েরা । শরৎচন্দ্র সেই সব অসহায় নষ্টা পতিতাদের নাম ও তাদের এই পথে আসার ইতিহাস কাগজে কলমে লিখে রাখতেন । এই সব পতিতারা

কোথা থেকে কখন কিভাবে দেহ ব্যবসার সাথে জড়িয়ে

পড়ে সেই সব ইতিহাস লিখে রাখার জন্যই শরৎচন্দ্র বারবার পতিতা পল্লীতে যাওয়া আসা করতেন । এভাবে

সাতশো পতিতাদের নাম ও জীবন কাহিনী তিনি একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন । কিন্তু দুর্ভাগ্য এই খাতা তিনি রেঙ্গুনে থাকা কালীন তার বাড়ি ভূষ্মীভূত হওয়ার কারণে তা নষ্ট হয়ে যায় । এ নিয়ে শরৎবাবুর মনে চাঁপা একটা কষ্ট ছিল । তিনি তার সাহিত্যে পতিতা মেয়েদের দিয়েছিলেন অমরত্ব ।রূপের পসরা সাজিয়ে দেহের আবেদন নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়েছিল তার দেবদাস উপন্যাসে চন্দ্রমুখী, শ্রীকান্ত উপন্যাসে পিয়ারী বাঈজি,আঁধারে আলো গল্পে বিজলি চরিত্র গুলো ।শরৎ চন্দ্র চট্রোপাধ্যায় তার উপন্যাসে এই সব নষ্ট নারীদের এমন ভাবে চিত্রায়ন করেছেন যে পাঠকের অলক্ষ্যেই তারা সম্পূর্ণ সার্থক নারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ।

সাহিত্যিক বনফুল শরৎ সাহিত্য পতিতা প্রবন্ধের ভূমিকাতে লিখেছেন "প্রবন্ধের নাম শরৎ সাহিত্যে পতিতা না হইয়া "শরৎ সাহিত্যে নারী " হইলেই অধিকতর শোভনীয় হইতো বলিয়া মনে করি । শরৎ

বাবুর পতিতা চরিত্র লেখনীতে 'পতিতা' চরিত্র ততটা পরিস্ফুট হয় নাই যতটা হইয়াছে নারী চরিত্র ।"

আর নারী চরিত্র মূল্যায়ন করতে গিয়ে শরৎ চন্দ্র লিখেছিলেন তার অসামান্য বই "নারীর মূল্য"। আমাদের মনে হয় বিশেষ করে নারীদের এই বইটি পড়া

উচিত ।

এখন প্রশ্ন হলো শরৎচন্দ্র কেন দিনের পর দিন পতিতা পল্লীতে পরে থাকতেন?

কেন তিনি চরিত্রহীন উপাধি নিয়ে পতিতা পল্লিতে সময় কাটাতেন? এই সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া কারো পক্ষেই সহজ সাধ্য নয় । কারণ তিনি ছিলেন অনন্য অসাধারণ প্রতিভাবান সাহিত্যিক ।একজন স্রষ্টা ।একজন সৃষ্টিশীল মানুষের মনের হদিস পাওয়া দুষ্কর ।তবে একথা অনিস্বীকার্য যে শরৎচন্দ্রের অবচেতন মনে একজন শ্বাসত নারী ছিল ।তার প্রতি শরৎ চন্দ্রের সহানুভূতি ছিল অপরিসীম । জীবনের বিভিন্ন স্তরে বিশেষ করে নিষিদ্ধ পল্লীতে সেই নারী কেই তিনি বারবার আবিষ্কার করে গেছেন । সত্যিকারের সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে তিনি কলঙ্ক কে মাথা পেতে নিয়েছিলেন ।প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জন্য তিনি দিনের পর দিন পতিতা পল্লীতে সময় কাটিয়েছেন । ঘুরে বেড়িয়েছন প্রত্যন্ত নিষিদ্ধ পল্লীতে । আসলে নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েরা তার উদাস উদ্ভ্রান্ত জীবনে ছড়িয়ে দিয়েছিল এক বহু মাতৃক রঙ ।

পতিতাদের মধ্যে তিনি যেমন এক শ্বাশত নারী কে ভালোবেসে ছিলেন বিনিময়ে তিনি সীমাহীন কলঙ্ক মাথা পেতে নিয়েছিলেন । এই কলঙ্কের অপবাদ ও দুঃসহ যন্ত্রণার ভার বহন করেছিলেন চিরকাল ।